প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা      

শিশু জন্মের পর থেকে যা-কিছু শিক্ষালাভ করত পরিবারের অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে তাকেই গতানুগতিক অর্থে বলা হয় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা । বর্তমান সমাজ পরিস্থিতিতে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে । তাই প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের পূর্বে আর শিক্ষাকে অনিয়ন্ত্রিত না রেখে সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে । 




         

          প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার সংজ্ঞা : -

প্রথাগত প্রাথমিক শিক্ষার আগে যে শিক্ষা, তাকে বলা হয় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা । সাধারণত পাঁচ বা ছয় বছর বয়সের আগের শিক্ষাকেই প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা বলে। 

           প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য : 

১. শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা এবং ব্যক্তিগত অভিযোজনের জন্য, যেমন-  পোশাক-পরিধান, টয়লেটের অভ্যাস, খাদ্যগ্ৰহণ, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির জন্য মৌলিক দক্ষতা গড়ে তোলা। 

২. প্রয়োজনীয় সামাজিক অভ্যাস ও আদবকায়দা গড়ে তোলা, দলগত কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহ দান করা এবং অন্যদের অধিকার ও সুযোগসুবিধার প্রতি অনুভূতিশীল করে তোলা ।

৩. শিশুকে তার অনুভূতি, আবেগ বুঝতে,

প্রকাশ করতে সাহায্য করা এবং নির্দেশনার মাধ্যমে প্রক্ষোভ বিকাশ ও পরিণমনে সাহায্য করা ।

৪. শিশুর নান্দনিক বোধকে উৎসাহিত করা ।

৫. শিক্ষার্থী যে পরিবেশে বাস করছে তাকে জানার এবং নতুন কিছু উদ্ভাবন ও পরীক্ষানিরীক্ষার সু্যোগ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে পরিবেশ আগ্ৰহী করে তোলা ।

৬. আত্মপ্রকাশের যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি করে শিশুর স্বাধীন চেতনা এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দান করা ।

৭. শিশুর চিন্তা ও অনুভূতিকে স্পষ্ট, সঠিক এবং সাবলীলভাবে ব্যক্ত করার ক্ষমতাকে বিকাশ করা ।

৮. সুস্বাস্থ্য, পেশিসমূহের সঠিক সমন্বয় এবং চলন ক্ষমতার মৌলিক দক্ষতাগুলির বিকাশসাধন করা ।

            প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামো : - 

কমিশনের মতে, প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা হবে ১ থেকে ৩ বছরের তা নিম্নে আলোচনা করা হল-

১. নার্সারি : নার্সারি বিদ্যালয়ে ২ থেকে ৪ বছরের শিশুর এখনে শিক্ষালাভ করবে ।

নার্সারির দুটি শ্রেণি থাকবে ।

 যথা- নিম্ননার্সারি ও নার্সারি ।

২. কিন্ডারগার্টেন : নার্সারির পর শিশুরা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হবে । কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ে শিশুর একবছর বা দু'বছর শিক্ষালাভ করবে । ৩/৪ বছর থেকে ৫/৬ পর্যন্ত শিশুরা এখানে শিক্ষালাভ করবে ‌।

          প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম : - 

কমিশন প্রাথমিক শিক্ষাকে দুটি স্তরে বিভক্ত করেছে- 

A. নিম্নপ্রাথমিক শিক্ষাস্তর : কমিশন নিম্নপ্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে নীচের বিষয়গুলির অন্তর্ভুক্তির কথা উল্লেখ করেছে -

১. ভাষা : মাতৃভাষা অথবা একটি আঞ্চলিক ভাষা ।

২. গণিত : গণিতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে । ভাষা ও গণিতকে শিখনের মৌলিক দক্ষতা হিসেবে বিচার করতে হবে। 

৩. পরিবেশ সম্বন্ধে ধারণা : ৩-৪-এর ক্ষেএে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান পাঠের ব্যবস্থা থাকা দরকার ‌। 

৪. সৃজনশীল কাজ : শিশুদের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশের জন্য সংগীত, কলা, নাটক ও বিভিন্ন হাতের কাজ করাতে হবে 

৫. স্বাস্থ্যশিক্ষা : এই স্তরে শিশুদের ভালো স্বাস্থ্যাভ্যাস গরে তোলার জন্য শিক্ষা দেওয়া দরকার ।

B. উচ্চপ্রাথমিক শিক্ষাস্তর : উচ্চপ্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে কমিশনের সুপারিশগুলি হল- 

১. আবশ্যিক দুটি ভাষা : মাতৃভাষা অথবা আঞ্চলিক ভাষা, হিন্দি অথবা ইংরেজি ।

২. গণিত : প্রাথমিক স্তরে গণিতের মধ্যে পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি পড়তে হবে ।

৩. সমাজবিজ্ঞান : এই স্তরে সমাজবিজ্ঞানের পাঠক্রমে থাকবে ইতিহাস, ভূগোল ও পৌরবিজ্ঞান ।

৪. চারুকলা : চারুকলার পাঠক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- অঙ্কন, চিএকলা, ভাস্কর্য প্রভৃতি হাতের কাজ ।


            প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : - 

আধুনিক কালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরণের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে । কমিশন বলেন, স্থানীয় প্রয়োজনের ভিত্তিতে দেশের যেখানে সম্ভব এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান করতে হবে । বর্তমান ভারতে যেসকল প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষাদান করে চলেছে সেই সকল প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল- 


১. ক্রেশ : ক্রেশ হল প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান । শিশুর কাছে এটি দ্বিতীয় পরিবারের মতো । এই প্রতিষ্ঠানে শিশু লালন-পালনের দিকটি অতি যত্নের সাথে করা হয় । এখানে সাধারণত জন্মের পর থেকে ২ - ২  ১/২ বছর পর্যন্ত শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্ব গ্ৰহণ করা হয় । শিশুরা প্রায় সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই সকল কেন্দ্রে থাকে । যেসকল পরিবারে

পিতা-মাতা উভয়েই চাকুরিজীবী সেই সকল পরিবারের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে এখানে লালিত-পালিত হয়ে থাকে। 

২. নার্সারি বিদ্যালয় : প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বা বিদ্যালয় হল নার্সারি বিদ্যালয় । নিম্নে এই

বিদ্যালয় সম্পর্কে আলোচনা করা হল - 

a. উদ্ভাবক : ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের দুই ভগ্নী মার্গারেট ম্যাকমিলান ও রাচেল ম্যাকমিলান লন্ডনে নার্সারি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন ।

b. উদ্দেশ্য : এই জাতীয় বিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল যে-সমস্ত পরিবারের আর্থসামাজিক-মর্যাদা কম সেই সমস্ত পরিবারের শিশুদের শিক্ষাদান করে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা ।

c. সময়কাল : সাধারণত ২ - ৪ বৎসরের শিশুরা নার্সারি বিদ্যালয়ে ভরতি হয় । সকালে অথবা দুপুরে সামান্য কয়েক ঘন্টার জন্য শিশুরা এইসব বিদ্যালয়ে সময় অতিবাহিত করে । এখানে শিশুরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ব্যাপক জ্ঞান আহরণ করতে পারে ।

d. পাঠক্রম : এই বিদ্যালয়ে শিশুদের ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় । পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি - খেলাধুলা, সংগীত, ছড়া বলা, ছবি আঁকা, গল্প বলা, নাচ ইত্যাদি । এ ছাড়া প্রাথমিক কাজগুলি নিজে যাতে করতে পারে তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ।

এক কথায় এইসব বিদ্যালয়ে শিশুদের দৈহিক, মানসিক বিকাশের উপযোগী কতকগুলি কার্যাবলির শিক্ষা দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে তারা সমাজের একজন উপযুক্ত নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে ।


৩. মন্তেসরি বিদ্যালয় : প্রাট্-প্রাথমিক শিক্ষার যেসকল বিদ্যালয় রয়েছে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মন্তেসরি বিদ্যালয় । এই বিদ্যালয়ের বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হল - 

a. প্রতিষ্ঠাএী : মন্তেসরি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাএী হলেন মাদাম মারিয়া মন্তেসরি ।

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত তাঁর বিদ্যালয়ের নাম হল       

'Casa Dei Bambini' (House for children) - এর অর্থ হল "শিশু নিকেতন" ।

b. বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য : এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হল শিশুদের ইন্দ্রিয়েরগুলিকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে শিশুরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ব্যাপক জ্ঞান আহরণ করতে হবে । 

c. শিক্ষাদানের বিষয়বস্তু : এই বিদ্যালয়ে কোনো ধরা-বাঁধা পাঠ্যক্রম নেই । সক্রিয়তা ও ইন্দ্রিয় অনুশীলনের মধ্য দিয়ে শিশুরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবে । বিভিন্ন প্রকারের শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে শিশু দুটি বস্তুর আকার, ওজন, রং ও তাপমাত্রার পার্থক্য বুঝতে পারবে ‌। শিশুদের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, সংগীত, উদ্যান রচনা, হাতের কাজ ইত্যাদির আয়োজন এই বিদ্যালয়ে রয়েছে । 

d. শিক্ষাদান পদ্ধতি : ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করা হয় । এখানে ইন্দ্রিয় অনুশীলনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় । ইন্দ্রিয় অনুশীলনের উপকরণগুলিকে ডাইড্যাকটিক অপারেটাস বলে । এগুলির মধ্যে কয়েকটি হল - লাল রঙের ঘনক, পিরামিড, গোলক, শঙ্কু, সিলিন্ডার, বিভিন্ন ওজনের কাঠের টেবিল এবং ছোটো ছোটো ঘন্টা ইত্যাদি । ভাষা এবং গণিত শেখাতে এই সকল উপকরণ সাহায্য

করে ।

৪. কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার যে-সমস্ত বিদ্যালয় রয়েছে কিন্ডারগার্টেন সেগুলির মধ্যে অন্যতম । কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল -  

a. প্রবর্তক : ফ্রেডরিক উইলহেম, অগাস্ট ফ্রয়েবেল 1837 খ্রিস্টাব্দে কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় স্থাপন করেন ।

b. অর্থ : 'কিন্ডারগার্টেন' কথাটির অর্থ হল

'শিশু উদ্যান' । বিদ্যালয় হল একটি উদ্যান স্বরুপ । শিশুরা হল সেই উদ্যানের চারাগাছ । 

c. উদ্দেশ্য : এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হল শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ । শিশুর ইন্দ্রিয় পরিমার্জনার সাথে সাথে স্বাস্থ্য, শারীরিক ও নানা ধরনের অভ্যাস গঠন করা ও মানসিক পরিমার্জনারও চেষ্টা করা । 

d. সময়কাল : কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ে ৪-৫ থেকে ৬-৭ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয় ।

e. পাঠক্রম : কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে খেলা, ব্যায়াম, ইন্দ্রিয়ের উৎকর্ষ সাধনের উপযোগী কাজ, কাঠের কাজ, গান করা, দলগতভাবে কাজ করা হয় । 

f. পদ্ধতি : কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলিতে ফ্রয়েবেল উদ্ভূত কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে । এই পদ্ধতি মূলত Gift and Occupation -এর সাহায্যে শিক্ষাদান করা হয়ে থাকে । কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি হল খেলাভিওিক পদ্ধতি । 

g. শিক্ষক : শিশুরা হল শিশু উদ্যানের চারাগাছ এবং শিক্ষক হলেন মালি । মালি যেমন তার পরিচর্যার মাধ্যমে উদ্যানের চারাগাছকে বড়ো করে তোলা তেমনি মালিরুপ শিক্ষক তার পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুর সার্বিক বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেন । 

৫. প্রাক্-বুনিয়াদি বিদ্যালয় : জাতির জনক মহাত্মা গান্ধি প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে

প্রাক্-বুনিয়াদি বিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠেছে । এ বিদ্যালয়গুলিতে শিশুর চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশে অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় । সেইজন্য এ বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে প্রাত্যহিক জীবনের উপযোগী কতকগুলি প্রাথমিক কাজকর্ম, আচার-আচরণ, সৃজনমূলক কাজকর্ম, উৎপাদনাত্মক কাজকর্ম, সামাজিক শিক্ষাসংক্রান্ত কাজকর্ম, সু-অভ্যাস, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয় । তবে এসব বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কোনো পাঠক্রম নেই । সামাজিক বিভিন্ন কারণে এইপ্রাক্-বুনিয়াদি বিদ্যালয়গুলো বেশিদিন স্থায়ী হয়নি । 

৬. বালশিক্ষামন্দির : বালশিক্ষামন্দির  অর্থাৎ এই বিদ্যালয়গুলি বুনিয়াদি ও মন্তেসরি বিদ্যালয়ের মাঝামাঝি একটি প্রতিষ্ঠান । বুনিয়াদি শিক্ষার ভালো গুণ এবং মন্তেসরি বিদ্যালয়ের ভালো গুণগুলির মিশ্রণে এই বিদ্যালয়টি তৈরি হয়েছে । এখানে বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম এবং মন্তেসরি বিদ্যালয়ের পাঠক্রমকে অনুসরণ করে পাঠ্যবিষয় স্থির করা হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের বিদ্যালয়গুলি বিশেষ স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি ।