মাটি বলতে কী বোঝায় ?
ভূপৃষ্ঠের ওপরে খনিজ ও জৈব পদার্থের দ্বারা গঠিত বিভিন্ন স্তরযুক্ত প্রাকৃতিক বস্তুকে মাটি বা মৃত্তিকা ( Soil ) বলে ।
লাতিন শব্দ সোলুম বা সোলাম থেকে সয়েল কথাটি এসেছে ।
-: পেডালজি( Pedology):-
মাটির উৎপত্তি,শ্রেণিবিভাগ, ভৌত- রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির ব্যাখ্যা মৃত্তিকা বিজ্ঞানের যে শাখায় করা হয়, তাকে পেডোলজি বলে ।
-: ইডাফোলজি ( Edaphology ):-
মৃত্তিকা বিজ্ঞানের যে শাখা উদ্ভিদের জন্ম, বৃদ্বি ও সংরক্ষণের মাধ্যম হিসেবে ব্যাখ্যা করে, তাকে ইডাফোলজি বলে ।
-: মাটির উপাদান :-
মাটি প্রধানত চারটি উপাদানে গঠিত ।
যেমন-
১.খনিজ উপাদান ( ৪৫ শতাংশ )
২. বায়ু ( ২৫ শতাংশ )
৩. জল ( ২৫ শতাংশ ) ও
৫. জৈব পদার্থ ( ৫ শতাংশ )
ভূপৃষ্ঠের ওপরে মাটি স্তরে স্তরে সজ্জিত থাকে । মাটির প্রস্থছেদকে প্রোফাইল বা পরিলেখ বলে ।
-: রেগোলিথ (Regolith ) :-
আবহবিকারের প্রভাবে ভূত্বকের ওপরে চূর্ণ- বিচূর্ণ বিয়োজিত শিলার শিথিল স্তরকে রেগোলিথ বলে ।
-: মাটির হোরাইজন ( Horizon ):-
মাটির প্রতিটি স্তরকে বলে ।
পরিনত অবস্থায় মাটিতে প্রধানত চারটি স্তর দেখা যায় । যেমন- A,B,C ও D স্তর ।
সবার নীচে D স্তর । D স্তরের ওপরে C স্তর।C স্তরের B স্তর ও B স্তরের ওপর A স্তর থাকে ।
D - স্তরের বৈশিষ্ট্য :-
পরিণত মাটিতে সবার নীচে থাকে D স্তর । এটি কঠিন শিলার স্তর ।
C - স্তরের বৈশিষ্ট্য :-
পরিণত মাটিতে D- স্তরের ওপরে C- স্তর থাকে । এটি দুর্বল,অর্ধ- বিয়োজিত শিলার স্তর । বিজ্ঞানীরা এই স্তরটির নাম দিয়েছেন আদি শিলা বা জনক শিলা বা স্তর ।
B - স্তরের বৈশিষ্ট্য :-
পরিণত মাটিতে C- স্তরের ওপরে B- স্তর থাকে । এটি প্রচুর খনিজ লবণ সমৃদ্ধ স্তর । B- স্তরের ওপরে A- স্তর থেকে বিভিন্ন খনিজ লবণ অপসারিত হয়ে এই B- স্তরে অনেকটাই সঞ্চিত হয় ।এই কারণে B- স্তরকে বাংলায় সঞ্চয়ন স্তর ও ইংরেজি পরিভাষায় ইলুভিয়াল লেয়ার বলে ।
A- স্তরের বৈশিষ্ট্য :-
পরিণত মাটিতে B- স্তরের ওপরে A- স্তর থাকে । এটি খনিজ লবণ- রিক্ত স্তর । এই স্তর থেকে প্রচুর খনিজ লবণ জলের মাধ্যমে নীচের স্তরে অপসারিত হয় । এই কারণে A- স্তরকে বাংলায় ধৌত স্তর ও ইংরেজিতে এলুভিয়াল লেয়ার বলে ।
-: ধৌতি প্রক্রিয়া ( Leaching):-
জলের মাধ্যমে মাটির একটি স্তর থেকে খনিজ লবণ ও অন্যান্য পদার্থের অপসারণকে ধৌতি প্রক্রিয়া বলে ।
-: হিউমাস স্তর (Humus) :-
মাটির A- স্তরের ওপরে মাটির হিউমাস স্তর থাকে । এটি মাটির পৃষ্টস্তর এবং বিয়োজিত জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ স্তর । প্রসঙ্গত, বিয়োজিত জৈব পদার্থকে হিউমাস বলে ।
সুক্ষ জীবাণুরা জৈব পদার্থকে বিয়োজিত করে যে কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন,হাইড্রোজেন, প্রোটিন ইত্যাদি সমৃদ্ধ পদার্থ সৃষ্টি করে, তাকে হিউমাস বলে । হিউমাস গঠন প্রক্রিয়াকে হিউমিফিকেশন বলা হয় ।
হিউমাস মাটির উর্বরতা বাড়ায় মাটিতে জল ও বায়ুর প্রবাহ সচল রাখে । মাটির গ্ৰথন ঠিক রাখে ।
মাটির প্রকারভেদ:
মাটিতে অজৈব অংশের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। অজৈব অংশে বালিকণা, সূক্ষ্মকণা,পলিকণা মিলেমিশে মাটির বুনট তৈরি করে। মাটির বুনটের ওপর ভিত্তি করেই মাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা-বেলে মাটি, দো-আঁশ মাটি ও এঁটেল মাটি।
বেলে মাটি:
এ ধরনের মাটিতে বালিকণার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। এ মাটির কণাগুলো আকৃতিতে বড় বলে মাটিতে যথেষ্ট ফাঁক থাকে এবং অনায়াসে পানি ও বায়ু প্রবেশ করতে পারে। এ মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা কম এবং মাটি উপরের স্তরে অনুর্বর। সমুদ্র উপকূল,চর এলাকা ও মরুভূমিতে এ মাটি দেখা যায়। তরমুজ, শসা, ফুটি, চীনাবাদাম, গোল আলু ও মিষ্টি আলু ইত্যাদি এ ধরনের মাটিতে ভালো জন্মে।
দো-আঁশ মাটি:
এ ধরনের মাটিতে বালি, পলি ও কর্দম কণা প্রায় সমান পরিমাণে থাকে। দো-আঁশ মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি। এ মাটির পানি শোষণ ও ধারণ ক্ষমতা দুই-ই বেশি। দো- আঁশ মাটি কৃষিকাজের জন্য বেশি উপযোগী। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলের মাটিই দো-আঁশ মাটি। কৃষিক্ষেত্রে দো-আঁশ মাটিকে আদর্শ মাটি বলা হয়। দো-আঁশ মাটিকে আবার বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যেমন- বেলে দো-আঁশ, পলি দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ। নিচে বিভিন্ন ধরনের দো- আঁশ মাটির পরিচয় দেওয়া হলো।
ক) বেলে দো-আঁশ:
এ ধরনের দো-আঁশ মাটিতে বালিকণার পরিমাণ বেশি এবং পলি ও কর্দম মিশ্রিত থাকে। এ মাটি ঝরঝরে প্রকৃতির এবং শস্য জন্মানোর খুবই উপযোগী। তিস্তার অববাহিকায় এ মাটির আধিক্য লক্ষ করা যায়। মুলা, তামাক, মরিচ ও কচু এ মাটিতে ভালো জন্মে।
খ) পলি দো-আঁশ:
এ ধরনের দো-আঁশ মাটিতে পলিকণার পরিমাণ বেশি এবং জৈব ও খনিজ লবণ সমৃদ্ধ থাকে। এ মাটি অত্যন্ত উর্বর ও সব ধরনের ফসলের উপযোগী। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পলি দো-আঁশ মাটি দেখা যায়। ধান, পাট, আখ, নানাবিধ সবজি এ মাটিতে ভালো জন্মে।
গ) এঁটেল দো-আঁশ:
এ ধরনের দো-আঁশ মাটিতে কর্দম কণার পরিমাণ বেশি থাকে। পানি ও জৈব ধারণ ক্ষমতা বেশি। বেশি বৃষ্টিপাত ও অনাবৃষ্টি ছাড়া সহজে চাষ উপযোগী। গঙ্গার অববাহিকা এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ধান, তুলা, গম, ডাল, তেল ফসল ভালো জন্মে।
এঁটেল মাটি:
এ ধরনের মাটিতে কর্দম কণার পরিমাণ বেশি থাকে । এঁটেল মাটিকে ভারী মাটি বলা হয়। এ মাটিতে বালিকণার চেয়ে পলিকণার পরিমাণ বেশি থাকে। পানি ধারণ ক্ষমতা বেশী কিন্তু নিষ্কাশন ক্ষমতা কম। পানির সংস্পর্শে এঁটেল মাটি নরম হয় আবার শুকালে খুবই শক্ত হয়। ধান, পাট, আখ ও শাকসবজি এ মাটিতে ভালো জন্মে।
0 মন্তব্যসমূহ